শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:২৬ পূর্বাহ্ন
মোঃ সিরাজুল ইসলাম
নারায়ণগঞ্জরূপগঞ্জ প্রতিনিধি
টানা কয়েক দিনের বর্ষণে রূপগঞ্জের ৩০ গ্রামের অন্তত ১৫ হাজার পরিবার এখন পানিবন্দি। তাদের দুর্ভোগ চরমে। ভেসে গেছে মাছের খামার। গত কয়েক দিনের অতি বৃষ্টিতে ও অপরিকল্পিতভাবে সেচ প্রকল্প নির্মাণ এবং পানি নিষ্কাশনের খালগুলো বেদখল ও ভরাট হয়ে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কোন কোন রাস্তা-ঘাট তলিয়ে গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষে ও মাঠে এবং রূপগঞ্জ থানার সামনের সড়কে হাঁটু সমান পানি। নির্মাণাধীন ডেমরা-রূপগঞ্জ-কালীগঞ্জ সড়কের বেহাল দশায় জনদুর্ভোগ চরমে। উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে মানুষ। আকাশে মেঘ জমলেই নারায়ণগঞ্জ-নরসিংদী সেচ প্রকল্পের ভেতরে বসবাসকারীদের মাঝে আতঙ্ক দেখা দেয়।
১৯৮৪ সালে ৯০ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে নারায়ণগঞ্জ-নরসিংদী অগ্রণী সেচ প্রকল্প-১ ও পরে ১৯৯৩ সালে ১০১ কোটি টাকা ব্যয়ে শীতলক্ষ্যার পূর্বপারের পাঁচ হাজার হেক্টর জমি ঘিরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। সেচ প্রকল্প নির্মাণ হওয়ার কয়েক বছর পরেই এখানে শুরু হয় জলাবদ্ধতা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার তারাবো পৌরসভার গন্ধর্বপুর উচ্চ বিদ্যালয় ভবনের নিচ তলার সকল শ্রেণিকক্ষ ও মাঠে হাঁটু সমান পানি। তাতে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি একেবারেই কম। এছাড়া গোলাকান্দাইল, মধ্যপাড়া, তারাবো, বৌবাজার, বরপা, ভুলতা, দক্ষিণপাড়া, খালপাড়, নাগেরবাগ, মদিনানগর, বাকমোর্চা, তারাবো পৌরসভার তেঁতলাবো, ইসলামবাগ, নতুন বাজার, কান্দাপাড়া, বলাইখা, বিজয়নগর, পশ্চিম কান্দাপাড়া, উত্তর মাসাবো, যাত্রামুড়া, রূপসী ও ভুলতা ইউনিয়নের মাঝিপাড়া, সোনাবো, পাঁচাইখা, ইসলামপুরসহ আশপাশের এলাকায় এখন জলাবদ্ধতা। বাড়ির উঠানে পানি। অনেকের ঘরেই হাঁটু থেকে কোমরপানি। রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। জমির ফসল হলদে হয়ে মরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। গবাদিপশু অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ঘরবাড়িতে পানি ওঠায় কেউ কেউ আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। আবার কেউ কেউ বাঁশের মাচার ওপর বসবাস করছে। কয়েকটি শিল্পকারখানায়ও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে টিউবওয়েল পানিতে তলিয়ে গেছে। সেই সব এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির অভাব। দেখা দিয়েছে খাবারের সংকট। কোন কোন রাস্তা-ঘাট তলিয়ে গেছে। রূপগঞ্জ থানার সামনের সড়কে হাঁটু সমান পানি। নির্মাণাধীন ডেমরা-রূপগঞ্জ-কালীগঞ্জ সড়কের বেহাল দশায় জনদুর্ভোগ বেড়েই চলছে। এ সড়কের নির্মাণ কাজ কবে শেষ হবে তা কেউ বলতে পারছে না। তাছাড়া শিল্পকারখানার নির্গত কেমিক্যাল ও দুর্গন্ধযুক্ত কালো পানিতে দূষণ হয়ে রোগাক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বিশেষ করে মহিলা ও শিশুদের দুর্ভোগ অবর্ণনীয়।
এদিকে চোরাবো-সমু মার্কেট সড়ক ডুবে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছে। বৃষ্টি বেশি হওয়ায় বালু ও শীতলক্ষ্যাসহ নদ নদীর পানীও বেড়েছে। তারাবো পৌরসভার নিন্মাঞ্চলের বসতঘরে হাঁটু সমান পানি। টানা ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নিন্মাঞ্চলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা স্থায়ীরূপ নিয়েছে। কোন কোন স্থানে অব্যাহত বৃষ্টিতে সেতুর সংযোগ সড়ক ডুবে গেছে।
দেবৈই গ্রামের রানা মন্ডল বলেন, সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় অতিকষ্টে চলছে নিম্ন আয়ের মানুষের সংসার। দেখা দিয়েছে খাবারের সংকট। শিল্পকারখানার নির্গত বর্জ্যে পানি নিষ্কাশন খালগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। শিল্পকারখানার নির্গত পানি কুচকুচে কালো রং ধারণ করেছে। এই পানিতে হাঁটাচলা করতে গিয়ে মানুষ চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। পানির কীট-পতঙ্গসহ মাছ মরে যাচ্ছে। আশপাশের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
বরপা শান্তিনগর গ্রামের রওশন আলী বলেন, ১০-১২ বছর ধরে এখানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই এখানে হাঁটু সমান পানি হয়। পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদের বাঁচতে হচ্ছে। কায়েতপাড়ার কামশাইর গ্রামের আমেনা খাতুন বলেন, তার ঘরে হাঁটুপানি। চুলায় আগুন জ্বালাতে পারেন না। ঘরে খাবার নেই। বিশুদ্ধ পানি নেই। শুকনো খাবার খেয়ে বাঁচতে হচ্ছে। অনেকে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন।
গোলাকান্দাইল এলাকার যুবদল নেতা রাজিব ভুঁইয়া বলেন, রূপগঞ্জ শিল্পাঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সে কারণে জমির দাম বেশি। তুলনামূলকভাবে নিচু জমির দাম কম। তাই অনেকেই নিচু অঞ্চলে কম দামে জমি কিনে ঘরবাড়ি নির্মাণ করছেন। আর সে কারণেই নির্মিত ঘরবাড়িতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
মুড়াপাড়া দড়িকান্দী এলাকার বিএনপি নেতা মজিদ ভুঁইয়া বলেন, দড়িকান্দী, গঙ্গানগর, কুলীনপাড়া, সরকারপাড়া এলাকার নিন্মাঞ্চলের ঘর বাড়িতে পানি উঠেছে। তলিয়ে গেছে কৃষকদের ফসলি জমি। বানিয়াদী এলাকার যুবদল নেতা কামাল হোসেন বলেন, স্থানীয় শিল্প কারখানা অপরিকল্পিভাবে স্থানে স্থানে বাঁধ নির্মাণ করায় ও বর্জ্য ফেলে পানি নি:ষ্কাশনের খাল বন্ধ করে দেওয়ায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নিয়েছে।
রূপগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার আফরোজা সুলতানা বলেন, শতাধিক বিঘা জমির শাক-সবজি ও ১৫/২০ বিঘা জমির রোপা আমনের বীজতলার ক্ষতি হয়েছে।
রূপগঞ্জ উপজেলা প্রকোশলী মেহমুদ মোর্শেদ উল আল-আমিন, অতি বর্ষণে ও পাহাড়ী ঢলে পানি বেড়ে যাওয়ায় চলাচলে কিছুটা বিঘœ ঘটছে। রাস্তা ঘাটের ক্ষতি হয়েছে। তবে পানি নি:ষ্কাশনের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোঃ রকিবুল আলম রাজিব বলেন, নারায়ণগঞ্জ-নরসিংদী সেচ প্রকল্প বøক-১ এর চারটি পাম্প ও অগ্রণী সেচ প্রকল্পে তিনটি সেচ পাম্প দিয়ে সার্বক্ষণিক পানি নি:ষ্কাশন করা হচ্ছে। তবে ভারী বৃষ্টিপাত না হলে পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাবে। বেদখল খাল উদ্ধার, ভরাট হয়ে যওয়া সেচ খাল সংস্কার করা হলে, শিল্প-কারখানার বর্জ্য পরিশোধন করে নির্গত করা হলে ও গণমানুষ সচেতন হলেই জলবদ্ধতা নিরসন সহজ হবে।
রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও তারাবো পৌরসভা প্রশাসক মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, পৌরসভার ভেতরে পানি নি:ষ্কাশনের জন্য ৩১ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছে। এ খাল দিয়ে যাত্রামুড়ার পাম্পহাউজের ৩টি ও রূপসী পাম্পহাউজের ৪টি পাম্প দিয়ে দিনরাত পানি নি:ষ্কাশন করা হচ্ছে। রূপগঞ্জের তিনটি সেচ প্রকল্পসহ বিভিন্ন জায়গার সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ চলছে। আগামী ২/৩ দিনের মধ্যেই ফল পাওয়া যাবে তবে এক মাসের মধ্যে জলবদ্ধতা স্থায়ীভাবে নিরসন হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
All rights reserved © 2020-2024 dainikparibarton.com
অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।